ঘরোয়া সমাধান

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চিরতার ভূমিকা

চিরতার ইংরেজি প্রতিশব্দ Swertia। চিরতা মূলত একটি ভেষজ উদ্ভিদ যা ভেষজ চিকিৎসা ও চিকিৎসা সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর এক একটি গাছের উচ্চতা প্রায় দেড় থেকে দুই মিটার। মূলত ফুল থাকা আবস্থায় পুরো গাছ তুলে রোদে শুকিয়ে ঔষধ তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। চিরতা মূলত জ্বর, অ্যালার্জি, চুলকানি, উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে। চলুন জেনে নি, চিরতা কিভাবে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ করে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চিরতার ভূমিকা

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চিরতার উপকারিতা

বর্তমান সময়ে ডায়াবেটিস বলতে গেলে প্রকট আকার ধারন করছে। ছোট থেকে বয়স্ক সকল বয়সী মানুষের ডায়াবেটিস হতে পারে। বিশেষ করে মোটা বা স্থুলকায় ও বয়স্কদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। চিরতা রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে। চিরতা দেহের অভ্যন্তরে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নামক হরমোন তৈরির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। তাতে রক্তের সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং ডায়বেটিসের সমস্যার উন্নতি হয়।

চিরতা কিভাবে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ করে?

চিরতার ব্যতিক্রমী হাইপোগ্লাইসেমিক বৈশিষ্ট্য শরীরের রক্তে শর্করার মাত্রাকে শান্ত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। β-অগ্ন্যাশয় কোষ থেকে ইনসুলিন উৎপাদন চিরতা ফর্মুলেশন গ্রহণে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এটি গ্লুকোজে স্টার্চের ভাঙ্গন কমাতে সাহায্য করে যা ফলস্বরূপ রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং অবশেষে ডায়াবেটিস পরিচালনায় সহায়তা করে। [1]

Swertia প্রজাতির বিভিন্ন উপাদান থাকা সত্ত্বেও, জ্যান্থোন হল এই প্রজাতির সবচেয়ে বিশিষ্ট প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত যৌগ, যার মধ্যে একটি স্বতন্ত্র পলিফেনলিক গঠন রয়েছে এবং অনেক ফার্মাকোলজিক্যাল প্রভাব দেখায়, যেমন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিম্যালেরিয়াল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিটিউমার, অ্যান্টি-ডায়াবেটিস এবং হেপাটোপ্রোটেকটিভ বৈশিষ্ট্য। 

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এস চিরতা ৯৫% ইথানোলিক নির্যাস; খাওয়ানোর পর, খালি পেটে ও গ্লুকোজ লোডেড অ্যালবিনো ইঁদুরগুলিতে উল্লেখযোগ্য রক্তে শর্করার কমার প্রভাব দেখা যায়। এস চিরতা নির্যাস মৌখিকভাবে দেওয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর অ্যালবিনো ইঁদুরের মধ্যে টলবুটামাইডের হাইপোগ্লাইসেমিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। [2]

চিরতার যত উপকারিতা

সুপ্রাচীনকাল থেকে চিরতা সমগ্র বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খেতে তিতা হলেও এটি নানান প্রাকৃতিক ও ভেষজ গুণাগুণে ভরপুর। এই তিতা খাবার আমাদের দেহের ভিতর থাকা বিষাক্ত পদার্থ পরিষ্কার করে দেহকে সুস্থ্য রাখে এবং পাশাপাশি বিপাকীয় কার্যক্রম বাড়ায়। এছাড়াও তিতা_জাতীয় খাবার নানা রোগের উপশম হিসেবে কাজ করে।

  • দেহে রক্তকোষ গঠনের মাধ্যমে রক্তশূন্যতা কমায়। ঋতুস্রাব বা মাসিকে অনেকের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। তাদের জন্য চিরতার রস অনেক উপকারী। এমনকি কোথাও কেটে গেলে সে কাটা স্থানে চিরতার রস লাগিয়ে দিলে দ্রুত রক্ত পড়া বন্ধ হয়। অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণ, নাক দিয়ে রক্তপড়া এসব বন্ধ করতেও চিরতা অত্যন্ত কার্যকর।
  • চিরতায় প্রচুর পরিমাণে হেপাটোপ্রোটেকটিভ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি শরীর থেকে টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে এবং লিভারকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এটি লিভারের নতুন কোষের পুনর্জন্মেও সাহায্য করে।
  • গবেষণায় পাওয়া গেছে, যারা নিয়মিত চিরতার রস খায়, তাদের দেহে ক্যান্সারের জীবাণু খুব সহজে ঢুকতে পারে না। বিশেষ করে স্তন ক্যান্সার রুখতে চিরতা অনেক উপকারী।
  • চুল পড়া কমাতে চিরতার ভূমিকা রয়েছে। মাথার চুল পড়া শুরু করলে এক কাপ পরিমান গরম পানিতে ৫-৭ গ্রাম চিরতা ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে পানি ছেকে নিয়ে সেই পানি দিয়ে মাথা ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে।
  • শীতকালে ঘা হলে কিছুতেই শুকাতে চায় না। এক্ষেত্রে আগের দিন রাতে এক কাপ গরম পানিতে ৫ গ্রাম চিরতা ভিজিয়ে রেখে পরদিন সেই পানি ছেঁকে পচা ঘা ধুয়ে দিতে হবে। এভাবে ২-৪ দিন চিরতা ব্যবহার করলে ঘায়ের পচানি চলে যাবে ও দ্রুত শুকাবে। 
  • উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল, উচ্চরক্তচাপ, মুটিয়ে যাওয়া মানুষের নিয়মিত চিরতার পানি পান করা উচিত।

যাদের অ্যাজমা বা হাঁপানি জাতীয় রোগ আছে তাদের জন্য চিরতা অনেক উপকারী। আধা গ্রাম চিরতার গুঁড়ো ৩ ঘণ্টা অন্তর মধুসহ চেটে খেলে হাঁপানি দূর হয়।

ডায়াবেটিক রোগীরা চিরতা কিভাবে খাবেন? 

আগের দিন রাতে শুকনো চিরতা গুঁড়ো ৪-৫ গ্রাম পরিমাণ এক গ্লাস (২৫০ মিলিলিটার) গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন ওটা ছেঁকে সকালে খালি পেটে খেতে হবে। এটি খেতে তিতা লাগলেও ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

শুধু কি চিরতা খেলেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে?  

চিরতা পাতায় বেশ কিছু এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা ডায়াবেটিস induced oxidative stress কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সাহায্য করে। তবে শুধুমাত্র চিরতা খেয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। হেলদি লাইফস্টাইলের পাশাপাশি চিরতা, মেথি, জাম, সজিনা এগুলো খেলে (প্রাকৃতিক উপায়ে) ভাল ফলাফল পাওয়া যায়।

একটানা কতদিন চিরতা খাওয়া যাবে? 

একটানা বেশি পরিমান কিংবা ১০ থেকে ১৫ দিনের বেশি চিরতা খাওয়া উচিত না, সমপরিমাণ দিন বিরতি নিয়ে আবার  খাওয়া উচিত। এতে চিরতা থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়।

চিরতা সেবনে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি?

উপকারের পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত চিরতা সেবনে ক্ষতি হতে পারে। 

  • গর্ভবতী মায়েদের ও শিশুদের খাওয়ানোর আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। 
  • ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিরতা খাওয়া ভাল। কারণ চিরতা ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্লাড সুগার লেভেল কমিয়ে আনে। অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়া হলে লো ব্লাড সুগারের প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
  • অতিরিক্ত চিরতা সেবনের ফলে আপনার ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। 
  • চিরতা অস্ত্রোপচারের সময় এবং পরে ব্যবহার না করাই ভাল।

পরিশেষে 

এই লেখা থেকে স্পষ্ট যে, ডায়াবেটিসে চিরতা ভালো কাজ করে। শুধু তাই নয়, এটি তিতা স্বাদের হলেও শরীরের জন্য খুবই উপকারী একটি ভেষজ। অন্যান্য অনেক রোগের জন্যও চিরতা খুবই উপকারী। তাই ডায়াবেটিসের রোগী ছাড়াও এটি যেকোন ব্যক্তি যদি নিয়মিত খেতে পারে, তাহলে রোগ-বালাই তার থেকে অনেক দূরে অবস্থান করবে।

Farhana Yeasmin

Farhana Yeasmin একজন পুষ্টিবিদ, কাজ করছেন ডায়েট এবং নিউট্রিশন কনসালটেন্ট হিসাবে। তিনি ফুড এবং নিউট্রিশনের উপর স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পুর্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে বিভিন্ন তথ্য এবং উপাত্ত দিয়ে Health বার্তার সহযোগিতা করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন থেকে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Back to top button