অশ্বগন্ধার উপকারিতা এবং খাওয়ার নিয়ম
অশ্বগন্ধা মূলত ভেষজ জড়িবুটির মধ্যে অন্যতম একটি উপাদান। সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসাবে অশ্বগন্ধা ব্যবহার হয়ে আসছে। মনে করা হয় ৬০০ খ্রিস্টাব্দ বা তারও আগে থেকে অশ্বগন্ধার ব্যবহার শুরু হয়েছে। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রেও একটি গুরুত্বপুর্ন উপাদান হিসাবে অশ্বগন্ধা স্থান পেয়েছে। এখনকার সময়ে বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল স্টাডিতেও মানব শরীরে এর উপকারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। [1]
আজকের এই লেখার মাধ্যমে জানতে পারবেন অশ্বগন্ধার বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে। এছাড়াও কোন রোগে এটি কিভাবে ব্যবহার করবেন এবং কতটুকু পরিমাণে খেলে এটি আপনার জন্য বেশি উপকারী হবে সে সম্পর্কেও জানতে পারবেন। তাহলে চলুন শুরু করা যাক।
অশ্বগন্ধা কি?
অশ্বগন্ধার প্রধান উপকারিতাগুলো জানার আগে অশ্বগন্ধা আসলে কি সেটা জানা জরুরি। এটি মূলত এক প্রকার ভেষজ উদ্ভিদ। ভারত, পাকিস্তান, স্পেন, আফ্রিকা, মধ্য প্রাচ্য এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এই গাছ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই গাছের পাতা, ফল, বীজ, শিকড় সবকিছুই আয়ুর্বেদিক ঔষুধ তৈরী করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। তবে এর শেকড়ের ব্যবহার সবচেয়ে প্রচলিত। ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে এটি অত্যাশ্চর্য ভেষজ নামেও পরিচিত।
মানসিক চাপ কমাতে এটি অধিক কার্যকরী বলে একে অ্যাডাপ্টোজেনও বলা হয়। অ্যাডাপ্টোজেনের অর্থ মানসিক চাপ মুক্তির এজেন্ট। তবে অশ্বগন্ধা নামের উৎপত্তি হচ্ছে ঘোড়ার থেকে। এর শেকড় থেকে ঘোড়ার মূত্রের মতো এক ধরনের গন্ধ আসায় এটি অশ্বগন্ধা নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Withania Somnifera।
অশ্বগন্ধায় উপস্থিত উপকারী উপাদানসমূহ
অশ্বগন্ধার এত এত গুণের প্রধান কারণ হচ্ছে এতে উপস্থিত ফাইটোকেমিক্যাল। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, অশ্বগন্ধার নির্যাসে ৩৫ ধরনের ফাইটোকেমিক্যাল উপাদান থাকে। যার ফলে সঠিক পরিমাণে ব্যবহার করলে এটি ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে। এছাড়াও এতে উপস্থিত অন্যান্য উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যালকালয়েড, স্ট্রেরয়ডাল, ল্যাক্টনস, ট্যানিনস, স্যাপোনিনস, উইথানন, উইথাফেরিন এ, ডি, ই , উইথাননোলাইড ইত্যাদি।
অশ্বগন্ধার কিছু গুরুত্বপুর্ন উপকারিতা
১। ঘুমের সমস্যা সমাধান করে
অশ্বগন্ধায় অ্যানজাইলটিক উপাদান থাকার কারণে এটি মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক এবং মনোযোগ বৃদ্ধি করে। আর মানুষের শরীরে স্ট্রেস এর পরিমাণ কম থাকলে এবং মস্তিষ্কের উপর চাপ কম থাকলে ঘুমের সমস্যা দূর হয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে অশ্বগন্ধা স্নায়ু শিথিল রাখতে সাহায্য করে। যার ফলে আপনার আর ঘুমের ওষুধের প্রয়োজন হবেনা।
২। যৌন ক্ষমতা ও যৌন উদ্দীপক
পুরুষের শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে প্রাচীনকাল থেকেই অশ্বগন্ধার সুনাম রয়েছে। এছাড়াও নিয়মিত এটি খেলে শরীরে টেস্টোস্টেরন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। যার ফলে যৌন আকাঙ্ক্ষা এবং ক্ষমতা দুই-ই বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল স্টাডিতেও প্রমাণিত হয়েছে যে এটি কামশক্তি বৃদ্ধি এবং শুক্রতারুল্যের সমস্যা সমাধান করে।
৩। থাইরয়েড সমস্যায় উপকারী
থাইরয়েড সমস্যায় অশ্বগন্ধা খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত এটি খেলে শরীরে থাইরয়েড হরমোন বৃদ্ধি পায়। তাই যাদের শরীরে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ কম থাকে তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী।
৪। ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে
কিছু কিছু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, অশ্বগন্ধা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এতে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যেগুলো শরীরে ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি পেতে বাঁধা দেয়। যার ফলে নিয়মিত অশ্বগন্ধা খেলে কোলন ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার, ওভারিয়ান ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার এবং ব্রেন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়।
৫। মাসিকের সমস্যায় কার্যকর
অধিকাংশ মেয়েদের মাসিকের সময় তীব্র পেটে ব্যথার সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে প্রতিমাসেই পিরিয়ড চলাকালীন তারা তীব্র অসুস্থতায় ভোগে। কিন্তু অশ্বগন্ধা এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে। নিয়মিত যদি নির্দিষ্ট পরিমাণে অশ্বগন্ধা খাওয়া যায় তাহলে পেটে ব্যথার এই সমস্যা থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। শুধু তাই নয়, অনিয়মিত মাসিকের সমস্যাও এটি সমাধান করে।
৬। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে
অশ্বগন্ধা মানবদেহে রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রনে রাখে। যার ফলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমে যায় এবং হৃদপিণ্ড অন্যান্য অনেক রোগ থেকেও সুস্থ থাকে। আর শরীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকার ফলে আর্থ্রাইটিসের ব্যথাও উপশম হয়। এছাড়া এটি শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাহায্য করে।
৭। ত্বক ও চুলের যত্নে সহায়ক
অশ্বগন্ধা যৌবন ধরে রাখতে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত অশ্বগন্ধা খেলে ত্বকের বলিরেখা কিংবা বয়সের ছাপ পড়ার মতো সমস্যা থেকে দূরে থাকবেন। এটি ত্বককে ভেতর থেকে সুস্থ রাখে এবং উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি চুল পড়া রোধ করে এবং চুলের গোঁড়া মজবুত করতে সাহায্য করে।
অশ্বগন্ধা খাওয়ার নিয়ম
অশ্বগন্ধার শেকড় এবং গুঁড়া দুইভাবেই খাওয়া যায়। তবে এখন অশ্বগন্ধা গুঁড়া খাওয়ার প্রচলন সবচেয়ে বেশি। কারণ বাজারে শেকড়ের থেকে গুঁড়া বেশি দেখা যায়। ভালো ফল পেতে প্রতিদিন ৪-৫ গ্রাম অর্থাৎ ১ চামচ অশ্বগন্ধা গুঁড়া খেতে পারবেন।
আপনি চাইলে এটি কুসুম গরম পানিতে মিশিয়ে, হালকা গরম দুধে মিশিয়ে অথবা মধু মিশিয়েও খেতে পারেন। প্রতিদিন সকালে ১ চামচ অথবা সকালে ১/২ চামচ আর রাতে ঘুমানোর আগে ১/২ চামচ খেতে পারবেন। তবে আপনার সমস্যার উপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞ একজন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অশ্বগন্ধা খাওয়া সবথেকে নিরাপদ।
অশ্বগন্ধা খাওয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
অশ্বগন্ধা সম্পুর্ন প্রাকৃতিক উপাদান অতিরিক্ত মাত্রায় সেবনের ফলে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবে অশ্বগন্ধা খাওয়ার সময় অবশ্যই কিছু বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা জরুরী।
- অশ্বগন্ধা খাওয়ার ফলে অনিদ্রার সমস্যা সমাধান হয় এবং ঘুম ভালো হয়। তাই এটি খাওয়াকালীন আলাদা ঘুমের ওষুধ না খাওয়াই উত্তম।
- আর একটানা দীর্ঘদিন অশ্বগন্ধা খেলে ডায়রিয়া, গ্যাস্ট্রিক, বমির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই একটানা কিছুদিন খাওয়ার পর আবার ১০-১৫ দিন গ্যাপ দিয়ে খাওয়া শুরু করতে হবে।
- যেহেতু অশ্বগন্ধা রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে, এতে করে রক্ত পাতলা হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। তাই কোন অস্ত্রপচারের আগে, পরে বা সমসাময়িক এটি খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। না হলে অধিক রক্তপাত হয়ে মারাত্মক বিপদ হতে পারে।
- অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবেই শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ফলে এটি খাওয়ার সময় অন্য কোন শর্করা কমানোর ওষুধ না খাওয়াই উত্তম। তা না হলে রক্তে শর্করার মাত্রা অধিক পরিমাণে কমে গিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- গর্ভবতী মহিলাদের অশ্বগন্ধা খেলে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর যেসব মায়েরা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ান তাদের ক্ষেত্রেও অশ্বগন্ধা না খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
অশ্বগন্ধা সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্ন
প্রতিদিন কি অশ্বগন্ধার গুঁড়ো খাওয়া যেতে পারে ?
নির্দিষ্ট পরিমাণে প্রতিদিন অশ্বগন্ধার গুঁড়া খাওয়া যাবে। ওয়েব এম ডি এর তথ্য অনুযায়ী, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন ১০০০ মিলিগ্রাম অশ্বগন্ধা ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত খেতে পারবেন। তবে সমস্যা অনুযায়ী সেবনের মাত্রা কমবেশি হতে পারে। তাই খাওয়ার আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। [2]
অশ্বগন্ধার গুঁড়া খেলে কি লম্বা হওয়া যায়?
অশ্বগন্ধার গুঁড়া খেয়ে লম্বা হওয়ার মতো কোন তথ্য এখনো প্রমাণিত হয়নি। তবে এটি আমাদের হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে এবং হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে। এছাড়াও এর আরও অনেক উপকারিতার কথা ইতোমধ্যেই আপনারা জানতে পেরেছেন।
কোথায় পাওয়া যাবে অশ্বগন্ধার গুঁড়া?
যেকোন সুপারশপেই এখন অশ্বগন্ধার গুঁড়া পাওয়া যায়। আবার বাজারেও বিভিন্ন দোকানে এর দেখা পাবেন। কিন্তু নির্ভেজাল গুঁড়া পাওয়া এখন খুবই কষ্টকর। কারণ বাজারের দোকানে যেগুলো দেখা যায় সেগুলো খোলা অবস্থায় থাকার ফলে ধুলাবালি মিশে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাই সুপারশপ থেকে অনলাইন স্টোর থেকে প্যাকেটজাত অস্বগন্ধার গুঁড়া কিনতে পারেন।
অশ্বগন্ধার কোন ক্ষতিকর দিক আছে কি?
অশ্বগন্ধার কোন ক্ষতিকর দিক নেই। তবে এটি খাওয়ার মাত্রার উপর নির্ভর করে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে যেগুলো উপরে বিস্তারিতভাবে বর্ননা দেওয়া হয়েছে। অশ্বগন্ধা খাওয়ার সময় শুধু এই ব্যাপারগুলো মাথায় রাখলেই চলবে।
মেয়েদের জন্য অশ্বগন্ধার কোন উপকারিতা কি?
মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় যে তীব্র পেটে ব্যথা করে, অশ্বগন্ধা সেটা লাঘব করে। এছাড়াও অনিয়মিত ঋতুস্রাবের সমস্যা এবং বন্ধ্যা নারীর ক্ষেত্রেও এর উপকারিতা লক্ষ্য করা গেছে। নিয়মিত এটি খেতে থাকলে শরীরের রক্ত চলাচল ঠিক থাকে এবং হরমোনাল ইমব্যালেন্স দূর হয়। ফলে মাসিকের সমস্যা ঠিক হওয়ার পাশাপাশি বন্ধ্যাত্বের সমস্যাতেও উপকার পাওয়া যায়। [3]
পরিশেষে
তাহলে বুঝতেই পারছেন ঔষধি গাছ হিসাবে অশ্বগন্ধার উপকারিতা অনেক বেশি। তাই নিয়ম মেনে সঠিক পরিমাণে যদি নিয়মিত এটি সেবন করতে পারেন তাহলে নানাবিধ রোগ থেকে দূরে থাকতে পারবেন। তবে নির্দিষ্ট কোন রোগের জন্য অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে অশ্বগন্ধা খাওয়া উচিত।
তথ্যসূত্রঃ healthline.com | webmd.com । medicalnewstoday.com